আল্লাহ তা’আলা মানবজাতিকে সৃষ্টি করেছেন তার ইবাদতের জন্য। ইসলাম ধর্মে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হচ্ছে নামাজ । কেয়ামতের দিন সর্বপ্রথম নামাজের হিসাব নেওয়া হবে। ঈমানের পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো নামাজ। নামাজ মানুষকে সকল প্রকার অশ্লীলতা থেকে দূরে রাখে। এটি এমন একটি ইবাদত যেটা ছাড়া জীবন অপূর্ণ। তাই নামাজের নিয়ম, গুরুত্ব ও মাসায়েল সম্পর্কে প্রত্যেক মুসলমানের জানা উচিত। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য ,বর্তমানে অধিকাংশ মুসলিম নামাজের গুরুত্ব সম্পর্কে উদাসীন। আবার অনেকে নামাজের সঠিক নিয়ম কানুন না জানার কারণে নিজেদের মন মতো নামাজ পড়ে থাকেন।ফলে নামাজ ভঙ্গ হয়ে যাওয়ারও সম্ভাবনা থাকে। তাই এই আর্টিকেল এর আলোচ্য বিষয় হিসেবে নামাজের নিয়ম, পরিচিতি,গুরুত্ব ও প্রকারভেদ সহ বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরা হয়েছে।
নামাজের পরিচিতি
নামাজ ফারসি শব্দ। আরবিতে একে সালাত বলা হয়। ইসলামের পাঁচটি ফরজ স্তম্ভের মধ্যে নামাজ অন্যতম।আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি আদায় এবং দয়া, ক্ষমা ও রহমত লাভের উদ্দেশ্যে বান্দা যে ইবাদত করে থাকে তাকে সালাত বা নামাজ বলে। নির্ধারিত সময়ে দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক মুসলমান নর নারীর জন্য ফরজ। ঈমানের পরে মুসলিমের সবচেয়ে বড় করনীয় হচ্ছে নিয়মিত নামাজ আদায় করা। কুরআনে প্রায় শত স্থানে এবং অসংখ্য হাদিসে নামাজের গুরুত্ব বোঝানো হয়েছে ।
কুরআনের আলোকে নামাজই সফলতার চাবিকাঠি । আল্লাহ তা’আলা বলেন,
“মুমিনগণ সফলকাম হয়েছেন, যারা অত্যন্ত বিনয় ও মনোযোগীতার সাথে সালাত আদায় করেন।” [ সূরা মুমিনুন]
নামাজের গুরুত্ব
নামাজ হলো মুমিন ও কাফিরের মধ্যে মাপকাঠি । নামাজ ত্যাগ করলে মানুষ কাফিরদের দলভুক্ত হয়ে যাবে। রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন, “একজন মানুষ ও শিরক- কুফরের মধ্যে পার্থক্য হলো সালাত।” তিনি আরো বলেন,” যে ব্যক্তি সালাত ছেড়ে দিলো, সে কুফরি করল।” [সহীহ ইবনু হিব্বান ৪/৩২৩, নং ১৪৬৩]
নামাজের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালার সাথে সরাসরি সম্পর্ক করা হয় । আল্লাহ তাআলার কাছ থেকে কোন কিছু নেওয়ার মাধ্যম হচ্ছে নামাজ ।তবে সেই নামাজ হতে হবে রাসুল (সাঃ) এর শেখানো পদ্ধতি অনুযায়ী। তাই নামাজের নিয়ম কানুন জানা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য অতীব জরুরি। আসুন তাহলে জেনে নেয়া যাক নামাজের নিয়ম সম্পর্কে।
নামাজের নিয়ম জেনে নিন
রাসূল সাঃ বলেছেন,” আমাকে যেভাবে সালাত আদায় করতে দেখো, সেভাবে তোমরা সালাত আদায় করবে’ [বুখারী (১৪-কিতাবুল আযান,১৮]
নামাজের নিয়ম সঠিকভাবে না জানার কারণে অনেকেরই নামাজ শুদ্ধ হয় না। এমনকি পূর্ণাঙ্গ নামাজের নিয়ম মেনে নামাজ না পড়লে সে নামাজ আল্লাহর দরবারে কবুল হবে না। ফলে সে নামাজ পড়া না পড়া দুটোই সমান হবে। তাই আজকে আপনাদের তুলে ধরব নামাজের নিয়ম সম্পর্কে।কয়েকটি বিষয়ে হাদিসের বর্ণনা বিভিন্ন প্রকারের হওয়ার কারণে মতপার্থক্য রয়েছে। তবে এখানে সংক্ষেপে প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো আলোচনা করা হলোঃ
- অজু, গোসল বা তায়াম্মুম করে পবিত্র হয়ে ,পবিত্র পোশাক পরিধান করে, সতর আবৃত করে কেবলামুখী হয়ে নামাজে দাঁড়ানো।
- এরপর অন্তরে নামাজের নিয়ত করা।
- অতঃপর আল্লাহু আকবার বলে দুহাত কব্জি পর্যন্ত অথবা কান পর্যন্ত উঠানো।
- তাকবীর শেষে বাঁ হাতের উপর ডান হাত রাখা । এভাবে হাত দুটি নাভি বা বুকের উপরে রাখা।
- তাকবীরে তাহরিমার পরে ছানা পাঠ করা।
- তারপর অনুচ্চস্বরে আ’উযুবিল্লা-হি মিনাশ শাইত্ব-নির রজিম পাঠ করা।
- এর পর অনুচ্চস্বরে বিসমিল্লা-হির রহ্বমা-নির রহ্বিম পাঠ করা।
- সূরা ফাতিহা পাঠ করা। সূরা ফাতিহা পাঠ শেষ হলে “আমিন” বলা। এরপর কুরআনের অন্য কোন সূরা বা কিছু আয়াত পাঠ করা।অতঃপর “আল্লাহু আকবার” বলে রুকুতে যাওয়া।
- এবার রুকু থেকে ‘সামিয়াল্লাহু লিমান হামিদাহ’ বলে মাথা উঠানো।রুকু থেকে উঠে পরিপূর্ণ সোজা হয়ে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকা। এটি নামাজের অন্যতম ওয়াজিব যা আদায় না করলে নামাজ নষ্ট হয়ে যাবে।
- এরপর সিজদা করা।সিজদা অবস্থায় দু পা, দু হাঁটু , দুহাত, কপাল ও নাক মাটিতে দৃঢ়ভাবে লেগে থাকবে।
- সিজদায় কমপক্ষে তিনবার ‘সুবহানা রাব্বিয়াল আলা’ পাঠ করা। এরপর আল্লাহু আকবার বলতে বলতে সিজদা থেকে উঠে বসা।
- দ্বিতীয় সিজদায়ও কমপক্ষে তিনবার তাসবিহ পড়া।তারপর ভূমিতে হাত দ্বারা ঠেক না দিয়ে এবং না বসে সরাসরি তাকবির বলে দাঁড়িয়ে যাওয়া।
- এ পর্যন্ত প্রথম রাকাত সম্পন্ন হলো।
- এখন আবার প্রথম রাকাতের মত করে দ্বিতীয় রাকাত আদায় করা ।তবে এক্ষেত্রে হাত উঠানো,ছানা এবং আউজুবিল্লাহ পড়তে হবে না।
- পূর্বের মতো সুরা ফাতিহার সঙ্গে অন্য একটি সুরা মিলিয়ে রুকু-সিজদা করা।
- দ্বিতীয় রাকাত পূর্ণ হলে তাশাহুদ এর জন্য বসা। দুই সিজদার মাঝে যেভাবে বসতে হয় সেভাবে বাম পা বিছিয়ে ডান পা খাড়া করে আঙ্গুলগুলো কেবলামুখি করে বসতে হবে। বাম হাত বাম উরু বা হাঁটুর উপর এবং ডান হাত ডান উরু বা হাঁটুর উপর থাকবে। ডান হাতের আঙ্গুলগুলো মুঠো করে শাহাদাত আঙ্গুলি বা তর্জনী দিয়ে তাশাহুদ ও দুআর সময় কেবলার দিকে ইঙ্গিত করা সুন্নত। দু’রাকাত সালাত হলে তাশাহুদ এর পর দরুদ ও দোয়া পাঠ করতে হয় ।তিন বা চার রাকাত হলে তাশাহুদ পড়ে উঠে দাঁড়াতে হবে। অতঃপর তৃতীয় ও চতুর্থ রাকাত শেষ করে অর্থাৎ শেষ বৈঠকে তাশাহুদ, দরুদ ও দু,আ পাঠ করা।
- সর্বশেষ সালামের মাধ্যমে নামাজ শেষ করা। একবার ডান দিকে মুখ ঘুরিয়ে আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ , আরেকবার বাম দিকে মুখ ঘুরিয়ে আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ বলে নামাজ শেষ করা।
নামাজের নিয়ম গুলো সঠিকভাবে মনে রেখে নামাজ আদায় করতে হবে।
নামাজের রাকাত সংখ্যা
দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা ফরজ।ফরজের পাশাপাশি প্রত্যেক ওয়াক্তেই ওয়াজিব, সুন্নত এবং নফল নামাজ রয়েছে। এরমধ্যে ফরজ, ওয়াজিব এবং সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ অবশ্যই পড়তে হবে। কিন্তু সুন্নতে যায়িদাহের ক্ষেত্রে কিছুটা ছাড় আছে। তাই এখানে রাকাতের আলোচনায় শুধু ফরজ, সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ ও ওয়াজিবের আলোচনা করা হয়েছে।[তিরমিজি, হাদিস: ৬৩৬২] নিচে ৫ ওয়াক্ত নামাজের রাকাত সংখ্যার তালিকা উল্লেখ করা হলো:
ফজর | ফজরের নামাজ মোট ৪ রাকাত। দুই রাকাত সুন্নত ও দুই রাকাত ফরজ। |
যোহর | যোহরের নামাজ মোট ১০ রাকাত। চার রাকাত সুন্নত ,চার রাকাত ফরজ ও দুই রাকাত সুন্নত। |
আসর | আসরের নামাজ ৪ রাকাত। চার রাকাতই ফরজ। |
মাগরিব | মাগরিবের নামাজ মোট ৫ রাকাত। তিন রাকাত ফরজ ও দুই রাকাত সুন্নত। |
এশা | এশার নামাজ মোট ৯ রাকাত। চার রাকাত ফরজ ,দুই রাকাত সুন্নত ও তিন রাকাত বিতর। |
নামাজের ফরজ সমূহ
নামাজের ফরজ কয়টি ও কী কী সেটা মুসলিম হিসেবে আমাদের প্রত্যেকের জানা জরুরি । কেননা নামাজের ফরজ ছুটে গেলে নামাজ বাতিল হয়ে যায়। সেক্ষেত্রে সাহু সিজদা করলেও নামাজ সহিহ হয় না। এজন্য নামাজের ফরজ সমূহ এবং নামাজের নিয়ম ভালভাবে জানা জরুরী
নামাজের বাইরে ও ভেতরে মোট ১৩ টি ফরজ।যথাঃ
নামাজের বাইরে ৭টি ফরজ
- শরীর পাক থাকা
- কাপড় পাক থাকা।
- নামাজের জায়গা পবিত্র হওয়া।
- সতর ঢাকা (অর্থাৎ পুরুষের নাভি থেকে হাঁটুর নিচ পর্যন্ত এবং নারীদের চেহারা, দুই হাত কবজি পর্যন্ত ও পায়ের পাতা ছাড়া গোটা শরীর ঢেকে রাখা। মনে রাখা আবশ্যক, পর্দার ক্ষেত্রে নারীদের পুরো শরীর সতরের অন্তর্ভুক্ত)।
- কিবলামুখী হওয়া।
- ওয়াক্তমতো নামাজ পড়া।
- অন্তরে নির্দিষ্ট নামাজের নিয়ত করা।
নামাজের ভেতরে ৬টি ফরজ
- তাকবিরে তাহরিমা, অর্থাৎ আল্লাহু আকবার বলে নামাজ শুরু করা।
- কিয়াম করা অর্থাৎ দাঁড়িয়ে নামাজ পড়া।
- কিরাত পড়া (অর্থাৎ পবিত্র কোরআন শরীফ থেকে ন্যূনতম এক আয়াত পরিমাণ তিলাওয়াত করা ফরজ)।
- রুকু করা। ( প্রত্যেক রাকাতে একবার রুকু করা ফরজ)
- দুই সিজদা করা।(প্রতি রাকাতে দুইটি সিজদা করা ফরজ)
- আখেরি বৈঠক ( অর্থাৎ নামাজের শেষ রাকাতে সিজদার পর তাশাহুদ পরিমাণ বসা)
নামাজ হলো জান্নাতের চাবিকাঠি। নামাজই মুমিনের সফলতার সোপান। নামাজের মাধ্যমেই রবের নৈকট্য লাভ করা যায়।আল্লাহ তা’আলা আমাদের সবাইকে খুশু খুযুর সহিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করার তৌফিক দান করুন। আমিন।